ছোট বেলা থেকে দেখে আসছি আমার নানা রেগে গেলে প্রায়ই বলেন, ‘মূর্খের সাথে আমি স্বর্গেও যেতে রাজি নই’। শরৎচন্দ্র-বঙ্কিমচন্দ্রের সব উপন্নাস উনার মুখস্ত। এই বয়সেও ঐসব উপন্নাস থেকে কোট করে আমাদের শুনান। উনার ধারণা মানুষ শিক্ষিত হলে মনে বড় হয়। সাধারণ আর দশজন থেকে উন্নত চিন্তা করে। শিক্ষিত মানুষ বর্ণবাদি হতে পারে না, লিঙ্গবাদী হতে পারে না। উনার কাছ থেকে শুনে শুনে আমিও বিশ্বাস করতে শুরু করি, শিক্ষা মানুষকে মনে বড় করে। শিক্ষার প্রতি একটা প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়। স্বপ্ন দেখি, বড় হয়ে শিক্ষক হব। মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো বিতরণ করব। একসময় শিক্ষকও হই। কিন্তু যত বড় হতে থাকি আমার ধারণা পাল্টাতে থাকে।
আমার আশেপাশে মানুষজনকে দেখে বুঝতে থাকি, শিক্ষা তাদের মনে বড় করতে পারেনি। পারেনি তাদের বর্ণবাদি বা লিঙ্গবাদী হওয়া থেকে পরিত্রাণ দিতে। অনেক শিক্ষিত, এমনকি বড়-বড় বশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নেওয়া, মানুষজনের লিঙ্গবাদের মানুষিকতা দেখে, শিক্ষার প্রতি, শিক্ষিতের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা অবশিষ্ট নাই।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করা কাউকে যখন দেখি, কন্যা সন্তান হওয়ায় তার স্ত্রীকে অবহেলা করছে, অপমান করছে, তখন মনে হয়, কেন এই শিক্ষা, কেন এই শিক্ষিত হওয়া? এদের সাথে স্বর্গে যেতে কি আমি রাজি আছি? এই যুগে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে কেউ কন্যা সন্তান মানে বোঝা মনে করছে, এবং কন্যা সন্তানের জন্য তার স্ত্রীকে দায়ী করছে। একটা জাতীর জন্য, এর চেয়ে ভয়ংকর আর একটিও দূঃসংবাদ আছে কিনা আমার সন্দেহ আছে।
লিঙ্গবাদ বাঙালীর মজ্জাগত। তারা মনে করে মেয়ে মানে নিম্নশ্রেণীর মানুষ যারা কথনোই পুরুষের সমান মানুষ নয়, এবং মানুষ হিসেবে লজ্জার কারণ। কাউকে যদি ছোট করতে হয়, সবচেয় মোক্ষম অস্ত্র হল তাকে মেয়েদের সাথে তুলনা করা। প্রায়ই শোনা যায়, কোন অপদার্থ ছেলেকে কেউ গালীগালাজ করছে এই বলে, ‘তুই কি মাইয়া মানুষ? তুই কি শাড়ীচুড়ী পরিশ?’।
মেয়েদের ছোট করার জন্য ব্যাঙালী প্রতিটি উপলক্ষ ব্যবহার করে। সেদিন এক ভদ্র মহোদয়কে দখেলাম, যিনি অস্টেলিয়াতে পিএইচডি করছেন, সহাস্যে তার এক বাংলাদেশি কলিগকে বলছে ‘আমি পোলার বাপ, পোলা ছাইড়া দিছি। মাইয়ার বাপেদের সাবধানে থাকতে হবে’। যেন মাইয়ার বাপ হওয়াও একটা লজ্জার ব্যাপার। কোন মেয়ে যদি পরীক্ষায় ফাস্ট হয়, এরা বলবে, ‘কেমনে ফাস্ট হইছে আমরা জানি’। যেন মেয়ে হলে কেউ নিজের যোগ্যতায় ফাস্ট হতে পারবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা নিজেদের প্রগতিশীল বলে পরিচয় দেয়, চা-দোকানে তাদের আড্ডার, কৌতুকের বিষয়বস্তুও এই মেয়েদের ছোট করে।
লোকে বলে, ‘শিক্ষা মহান ব্রত’ । যে শিক্ষা মানুষকে ছোট করতে শেখায়, সে শিক্ষা কখনো মহান হতে পারে না। শিক্ষাকে মহান করতে হলে, স্কুল শিক্ষার চেয়ে আমাদের বেশি দরকার মানবিক শিক্ষার। কিন্তু দূঃখের বিষয়, স্কুল শিক্ষায় কিছুটা মনোযোগী হলেও, মানবিক শিক্ষায় আমাদের বিন্দুমাত্র মনযোগ নাই।