আমার মূল লেখাটি প্রথম আলো প্রকাশ করেছে। পড়া যাবে এখানে।
করোনা (কোভিড-১৯) মহামারি ভয়ংকরভাবে আঘাত করেছে আমাদের স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, ব্যক্তি এবং সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে। করোনার কারণে ইতিমধ্যে পৃথিবীব্যাপী ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক মন্দার অবস্থা তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক শেয়ার মার্কেট পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে, পরিবহন এবং বাণিজ্য খাতে হাজারো কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে আছে, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ বেশি সেবা দিয়েও সংকুলান করতে পারছে না।
মানুষ সর্বদা ভয়ের মধ্যে আছে কখন এই রোগে আক্রান্ত হয়, কখন কাছের মানুষকে হারাতে হয়। অধিকাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছে। তাদের গৃহবন্দী হয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে। এসব কিছুই প্রভাব ফেলছে মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক আচরণে। পত্রপত্রিকায় প্রায়ই মানুষের অস্বাভাবিক আচরণের খবর আসছে।
যেকোনো এলাকায় মহামারি এবং এর দ্বারা সৃষ্ট মানসিক ও সামাজিক অশান্তি সমাধানে ওই এলাকার মহামারি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা অত্যাবশ্যক। মহামারি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনৈতিক ক্ষতি কমিয়ে আনতে পারে এবং সমাজে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারে। বিশেষ করে মানসিক ও সামাজিক অশান্তি তৈরি হওয়ার আগেই এর সম্ভাবনা জানতে পারলে যথাযথ ব্যবস্থার মাধ্যমে একে প্রতিরোধ করা সম্ভব।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ব্লগ এবং অনলাইন নিউজ পোর্টালে সাধারণ মানুষের মন্তব্য) কোনো এলাকার মহামারি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। মানুষ তার চারপাশে যা ঘটতে দেখে এবং সেসব নিয়ে সে যা অনুভব করে, তা নিঃসংকোচে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করে। এসব তথ্যভান্ডার তৈরি করে বিগ-ডাটা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে বিগ-ডাটা তৈরি হয় তা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম ব্যবহার করে অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে সহজেই জানা যায়:
১.
সমাজে কী হচ্ছে,
২.
সাধারণ মানুষের সেন্টিমেন্ট বা অভিমত কী,
৩.
মানুষ কী বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে,
৪.
কোন বিষয়গুলো মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে এবং
৫.
সে বিষয়গুলো সমাজ এবং ব্যক্তিকে কীভাবে প্রভাবিত করছে, ইত্যাদি।
বিগ-ডাটা থেকে বিভিন্ন সময়ে মহামারি আসার ঠিক আগমুহূর্তে, মহামারির সময় এবং মহামারি শেষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু, আলোচনার ধরন, অনুভূতি এবং প্রতিক্রিয়া অ্যানালাইসিস বা পর্যালোচনা করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম মহামারি শুরু হওয়ার আগেই এর সম্ভাবনা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। একইভাবে কী কী মানসিক ও সামাজিক অশান্তি তৈরি হচ্ছে বা হতে পারে তার ধারণাও দিতে পারে। তবে এর জন্য দরকার যথাযথভাবে এসব তথ্যের সংগ্রহ, পর্যালোচনা, ব্যাখ্যা এবং মূল্যায়ন।
প্রথাগত পদ্ধতি যেমন ‘ক্লিনিক্যাল রিপোর্ট জরিপ’–এর তুলনায় বিগ-ডাটার মূল সুবিধা হচ্ছে কম খরচ, তাৎক্ষণিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত। ক্লিনিক্যাল রিপোর্ট জরিপের মাধ্যমে মহামারি থেকে ধারণা পাওয়া সময় ও বিনিয়োগসাপেক্ষ এবং পুরো প্রক্রিয়া বেশ জটিল। বিশেষ করে, মানুষ যেহেতু সাধারণ বিষয়গুলো নিয়ে এবং অসুস্থতার প্রথমিক পর্যায়ে সাপোর্ট সিস্টেম বা হেলথকেয়ার সার্ভিসে যোগাযোগ করে না, তাই ক্লিনিক্যাল রিপোর্ট জরিপে প্রকৃত চিত্র পেতে কয়েক সপ্তাহ সময় লেগে যায়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিগ-ডাটা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু সফল প্রকল্প সম্পাদন হয়েছে। যেমন হারিকেন আইরিনের সময় মানুষের অভিমত যাচাই হয়েছিল ২০১২ সালে, ইলেকশনের ফলাফল ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল ২০০৪ সালে, মানসিক সমস্যার ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল ২০১৭ সালে। সাম্প্রতিক সময়ে কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে আমাদের গবেষণা গ্রুপ ২.৯ মিলিয়ন করোনাভাইরাস–সম্পর্কিত অস্ট্রেলিয়ান টুইট কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম ব্যবহার করে অ্যানালাইসিস করে দেখেছে যে টুইটারের বিগ-ডাটা করোনা (কোভিড-১৯) মহামারি সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধারণা দিতে পারে যা সরকারি তথ্য এবং সংবাদে প্রকাশিত তথ্যের সঙ্গে দারুণভাবে মিলে যায়। এই সম্পর্কিত আমাদের গবেষণাপত্র একটি প্রথম সারির আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে জমা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের করোনা মহামারির পরিস্থিতি মোকাবিলায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিগ-ডাটা অ্যানালাইসিস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশে যেহেতু টুইটার খুব বেশি জনপ্রিয় নয়, অন্যদিকে ফেসবুকের বিগ-ডাটা সংগ্রহ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিয়ন্ত্রিত, তাই অন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে বিগ-ডাটা যুক্ত করা যেতে পারে। বিশেষ করে অনলাইন সংবাদ এবং এসব সংবাদে সাধারণ মানুষের মন্তব্য, জনপ্রিয় ব্লগ পোর্টালের ব্লগপোস্ট এবং সেখানে মন্তব্য। কেউ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মেশিন লার্নিং দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিগ-ডাটা অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে বাংলাদেশের করোনা মহামারির পরিস্থিতি মোকাবিলায় কাজ করতে চাইলে আমাদের গবেষণা গ্রুপ কোলাবরেশন করতে আগ্রহী। এই সম্পর্কিত যেকোনো তথ্যের জন্য আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে।